১৯৭১ সাল। লেফটেন্যান্ট হাবিবুর রহমান, যিনি করাচী বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, একজন বাঙালি। মার্চে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন তখন তাঁর মত আর বাকি বাঙ্গালিদেরও যারা পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন , তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করা হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়। অন্যদের মত জনাব হাবিবুর রহমান ও চিন্তিত ছিলেন, ভীত ছিলেন । চিন্তিত ছিলেন দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর ভীত ছিলেন উনার স্ত্রী আর এক বছর বয়সী ছেলের কথা ভেবে যারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিল। ফাতেমা বেগম , হাবিবুর রহমান সাহেবের স্ত্রী, যিনি স্বামীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছুই অবগত নন, উনার এক মাত্র ছেলেকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে স্বামীর অপেক্ষায় আছেন। ঢাকায় উনার কোন আত্মীয় স্বজন নেই । উনার একাই পুরা সপ্তাহ কাটে । হাবিবুর রহমান সাহেব প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়ি আসেন আবার শনিবার সকালে চলে যান। আর ঠিক সেই সময়, পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে , ফাতেমা বেগম ছেলেকে কোলে নিয়ে বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন হয়তো স্বামী এই সপ্তাহে ও বাড়ি ফিরবে কিন্তু কয়েকশ কিলো মিটার দূরে থাকা স্বামীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি যেমন অগোচর ছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে ও তিনি নিশ্চিত ভাবে কিছু জানতেন না। আবছা আবছা ভাবে শুধু জানতেন স্বাধীনতার ঘোষণা আসতে পারে যে কোনদিন। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি নরপশুরা যে অত্যাচার আর হত্যাযজ্ঞ চালায় এর কিছুই কারাগারের ভেতর হাবিবুর রহমানের কানে পৌঁছায় নি , পৌঁছায় নি ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ডাক ও। উনার স্ত্রী সন্তান বেঁচে আছে কি মরে গেছে উনি তাও জানতেন না । জানতেন না যে বঙ্গবন্ধু কে গ্রেফতার করা হয় ঐদিন রাতেই | অপরদিকে ঢাকায় সেই কালরাতে ফাতেমা বেগম সারারাত খাতের নিচে লুকিয়ে ছিলেন তাঁর ছেলেকে নিয়ে । আসেপাশের গোলাগালির আওয়াজ আর মর্টারের শেলের শব্দে তিনি বার বারই কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন । আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে সেই ভয়ংকর রাত কোন মতে শেষ হল । তিনি নিজে ও জানতেন না কি অলৌকিক ভাবে ঐদিন বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। পরদিন সকালেই গ্রাম থেকে উনার বাবা গফুর সাহেব আসলো মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের খবর নিতে , তাদের সাথে করে গ্রামে নিয়ে যেতে । দুপুরের দিকে যখন কারফিউ উঠানো হল তিনি তখন। শ্যামলীতে মেয়ের বাসায় এসে পৌঁছালেন। মেয়েকে জীবিত দেখে তিনি একদিকে যেমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন অপরদিকে মেয়ের ভয়ার্ত চেহারা দেখে তিনি কেঁদেও ফেললেন। ফাতেমা বেগম ও বাবাকে কাছে পেয়ে আর কান্না আটকাতে পারলেন না । উনার ভয় কিছুটা দূর হল । গফুর সাহেব মেয়েকে নিয়ে তাড়াতাড়ি গ্রামে রওনা হতে চাইলেন কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসল , স্বামীকে ছাড়া উনি কিছুতেই যাবেন না । গফুর সাহেব মেয়েজামাই বেঁচে আছে কিনা নিশ্চিত ছিলেন না তাই মেয়েকে আর একা ঢাকায় রাখতে চাইলেন না একপ্রকার জোর করেই তিনি মেয়েকে নিয়ে গ্রামে রওনা হন। মেয়েকে বললেন গ্রামে যেয়ে হাবিবুর সাহেবের খবর নিবেন উনার আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে ওনারা পাশাপাশি দুই গ্রামের বাসিন্দাই ছিলেন। উনি ভাবলেন হয়তো এভাবে খোঁজ খবর নেয়া সহজ হবে যদিও মেয়েকে এর কিছুই বললেন না। অপরদিকে শত মাইল দূরে কারাগারে বন্দি হাবিবুর রহমান সাহেব আবছা আবছা ভাবে দেশের খবর পাচ্ছিলেন। গুজব আসলো পাকিস্তানিরা ঢাকার উপর গণহত্যা চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় আর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার প্রায় সবাইকেই মেরে ফেলেছে । আবার শুনলেন বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে এবং পূর্ব পাকিস্তান দখল করে বসেছে । আবার শুনলেন পূর্ব পাকিস্তানিরা নাকি যুদ্ধে নেমে পড়েছে। কিন্তু কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা কেউ বলতে পারছে না। বাকি বন্দিদেরও তাঁর মত অবস্থা। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। উনাদের সেলের মত আশে পাশের সেলেও অনেক বাঙালিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে । তাদের ভবিষ্যৎ কি কেউ বলতে পারছে না। দেশে তখন ভালভাবেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছিল। আমরা বাঙ্গালিরা ২৫শে মার্চের দুঃখ ভুলে ঠিকই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম । এদিকে প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। ফাতেমা বেগম গ্রামে এসে নিরাপদে আছেন ঠিকই কিন্তু মনে স্বস্তি পাচ্ছেন না। এখনও হাবিবুর রহমান সাহেবের কোন খোঁজ কেউ দিতে পারে নি। উনার শ্বশুর শাশুড়ি ও ছেলের খোঁজে লোক লাগিয়েছেন কিন্তু কেউ। কোন সঠিক খবর দিতে পারছে না। এদিকে মেয়ে জামাইয়ের খোঁজ বের করা অপরদিকে পাক হানাদার বাহিনী দিন দিন গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে , তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য গফুর সাহেব কি করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। একমাত্র মেয়েকে সান্ত্বনা দিবেন নাকি বাঁচার উপায় খুঁজবেন তাও তিনি বুঝতে পারছেন না। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি একটা বুদ্ধি বের করলেন। উনার বিশাল বড় কলাবাগান ছিল । লোক ঠিক করে তিনি সেই বাগানের মাঝে গর্ত খোঁড়ার নির্দেশ দিলেন যেন হানাদার বাহিনী এসে পড়লে পরিবার নিয়ে সেই গর্তে আশ্রয় নিতে পারেন । হয়তো এতে শেষ রক্ষা হবে না কিন্তু সেই মুহূর্তে তাঁর মাথায় এর চেয়ে ভালো কিছু আর আসছিল না। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি । যুদ্ধের প্রায় কয়েক মাস চলে গেছে। হাবিবুর রহমান সাহেব তখনও কারাগারে বন্দি। বন্দি থাকতে থাকতে শারীরিক ভাবে তিনি ভেঙ্গে পড়েছেন কিন্তু মনোবল তাঁর এখনও অটুট । তিনি পুরোপুরি নাস্তিক একজন মানুষ কিন্তু ইদানিং তাঁর মাঝে মাঝে মনে হয় হয়তো কেউ একজন আছেন, যিনি সব দেখেন। সেই একজন উনার স্ত্রী আর পুত্রকে ভালোই রেখেছেন এটা ভাবতে তাঁর ভালো লাগে। এদিকে আশে পাশের সেলে বন্দি থাকা কয়েদির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে । কেউ বলছেন তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে , কেউ বলছেন তাদেরকে নিয়ে মেরে ফেলে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। পানিতে । কিন্তু যেই যাচ্ছে সে আর ফিরে আসছে না। আরও শুনতে পাচ্ছেন কারাগার থেকে নিয়ে যাবার আগে নাকি একবার ভাল করে খাবার দেয়া হয় , মিষ্টি জাতীয় কিছু দেয়া হয়। তারপরই নাকি নিয়ে বদ্ধভূমিতে দাঁড় করিয়ে সাথে সাথেই ব্রাশফায়ার । অপরদিকে গ্রামে ফাতেমা বেগম নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এখনও উনার স্বামীর কোন খোঁজ। খবর পাননি। গ্রামে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশ করেছে দুই দিন আগে। গফুর সাহেব পরিবার নিয়ে সেই গর্তে আশ্রয় নিয়েছেন । ঘন সেই বাগানের ভেতর সূর্যের আলো ও প্রবেশ করতে পারে না ঠিক মত । তারপর ও তিনি গর্তের মুখ কলা গাছ আর পাতা দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। আশা হয়তো প্রাণে বেঁচে যাবেন। প্রায়ই গর্তের উপর দিয়ে গোলাগুলির আওয়াজ কানে আসে তাঁর। ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিক। হানাদার বাহিনী গ্রাম ছেড়ে যাবার কিছুদিন পরই গফুর সাহেব পরিবার নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছেন। গ্রামের চারপাশে শুধু লাশের গন্ধ। অনেককেই তারা মেরে ফেলে গেছে। নদীতে ও পচাগলা লাশ জমে আছে । এগুলা সরাতেও কেউ এগিয়ে আসছে না। এদিকে মেয়ের মুখের দিকে ও তিনি চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না। যাদের লাগিয়েছিলেন মেয়েজামাইয়ের খোঁজ বের করতে তারা কোন খবরই দিতে পারেনি। তিনি মনে মনে খারাপটাই ভেবে নিয়েছেন। অপরদিকে কারাগারে প্রায়ই গুজব কানে আসছে যে পাক বাহিনী যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে । ইন্ডিয়া ও নাকি বাঙ্গালিদের যুদ্ধে সহায়তা করছে। কিন্তু এসব খবরও আর কারাগারের বাসিন্দাদের উত্তেজিত করছে না। কারন কান পাতলেই শুনা যাচ্ছে যে বন্দিদেরকে ধরে ধরে মেরে ফেলা হচ্ছে। প্রথমে তাদেরকে গোসল দেয়া হয় তারপর ফিরনি জাতীয় কিছু একটা খাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বধ্যভূমিতে। কয়েক মাস আগে ওনারা যে গুজব শুনেছিলেন সেটা আসলে সত্য ছিল। নির্মম সত্য। অবশেষে একদিন কাক ডাকা ভোরে কারাগারের সিপাহী এসে হাবিবুর রহমান সাহেব ও উনার সাথের চারজনকে গোসল করে তৈরি হতে বললেন । গোসল শেষে ফিরে এসে উনারা দেখলেন। তিন বার্টিফিরনী এসেছে উনাদের জন্য । সিপাহী উনাদেরকে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বলল । ফিরনি দেখেই বন্দিদের একজন কাঁদতে শুরু করলেন। হাবিবুর রহমান সাহেবের ও মনোবল ভেঙ্গে গেল। উনি ভাবলেন আজকেই তাহলে শেষ। উনি বাটিটা হাতে নিলেন।
পরিশিষ্ট এই ঘটনার দীর্ঘ ৪৮ বছর পর , হাবিবুর রহমান সাহেবের ছোট ছেলে "স্বাধীনতা দিবস" নামে একটি গল্প লিখে। হু! বাবা সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন অনেকটা অলৌকিক ভাবেই । যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন আমার মায়ের কাছে। সবাই তাকে মৃত বলে ধরে নিলেও আমার মা মনে করতেন একদিন বাবা ফিরে আসবেই | হয়তো সেই বিশ্বাসেই বাবা ফিরে এসেছিলেন। দীর্ঘ ৯ মাস বন্দি অবস্থায় থাকার কারনে বাবার ডায়াবেটিক হয়ে গেছিল। এছাড়া তিনি সুস্থই ছিলেন। আর সব চেয়ে বড় ব্যাপারটা হল , তিনি পুরোপুরি আস্তিক হয়ে গেছিলেন। এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন কখনই বাবার নামাজ মিস হয় নি। এই ঘটনার কিছুটা আমার বাবার কাছে শোনা আর বাকিটা আমার মায়ের কাছ থেকে । যুদ্ধের পর বাবা আর বিমান বাহিনীতে ফিরে যান নি ।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
গল্পটি পড়তে পড়তে স্বাধীনতা লাভের অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা মনে আসছিল । সুন্দর লিখেছেন । শুভকামনা রইল ।
রণতূর্য ২
গল্পটি পড়ার সময়ই মনে হচ্ছিল এটি সত্য ঘটনা।ধন্যবাদ গল্পটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।একাত্তরে আত্মত্যাগকারী প্রত্যেককে আল্লাহ উত্তম বদলা দান করুক। সময় পেলে ঘুরে আসবেন আমার পাতায়।একটি কবিতা লেখার চেস্টা করেছিলাম। :)
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর যে হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালায় , যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার ঘোষণা আসে এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং বাংলাদেশের জন্ম হয় । এই যুদ্ধ আমাদের অনেকের জীবনকেই আমূল বদলে দিয়েছে , অনেক না বলা ঘটনার জন্ম দিয়েছে যার সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ।তাই স্বাধীনতা দিবস কোটি কোটি বাঙ্গালীর জীবনে সুগভীর তাৎপর্য বহন করে ।
উপরে উল্লিখিত গল্পটি তেমনি এক সত্য ঘটনার উপর লিখা , এমন ঘটনা যা কখনো কাউকে বলা হয় নি ।
০৫ ফেব্রুয়ারী - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।